A review by aadrita
বিরূপকথা by তানজীম রহমান

5.0

পড়া শুরুর আগে এক বন্ধুকে বিরূপকথা কেমন জিজ্ঞেস করায় উত্তর পেয়েছিলাম, "এটা এবসার্ড একটা বই"। পড়া শেষ করে আমি একমত, বিরূপকথা আসলেও কিম্ভুতকিমাকার অদ্ভূত একটা বই। এমন বইয়ের রিভিউ করাটা কষ্টসাধ্য। তবুও মনে হলো বইটার আরেকটু বেশি প্রচারণা দরকার, তাই নিজের বিচ্ছিন্ন অনুভূতিগুলো জানানোর চেষ্টা করতে এলাম৷

সবুজহাতি গ্রামের দেবতা মেঘমল্লার। নামের সাথেই মিল রেখে তার আছে মেঘ, বৃষ্টি, বাতাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। অনেকদিনের ইচ্ছা কোনো এক শহরের দেবতা হওয়ার। দেবতা বিবর্জিত এক শহর খুঁজে পেয়ে মল্লারের সেখানকার দেবতা হয়ে ওঠা বা না ওঠার গল্পই বিরূপকথা। লেখকের ভাষ্যমতে বইটা বড়দের জন্য লেখা রূপকথা, অনেকটা রূপকথার আদলেই লেখা পুরোটা। ফ্যান্টাসী গল্পগুলোকে আমার সবসময়ই আয়না বলে মনে হয়। কল্পনার রাজ্যে জাদুটোনা আর ব্যখ্যাতীত জিনিসপাতির আড়ালে যেন বাস্তবতাই উঁকি দিয়ে যায়৷ বিরূপকথাও ব্যতিক্রম নয়৷ চরিত্রগুলোর মাঝে, তাদের কাজকর্মের মাঝে একাধিকবার খুঁজে পেয়েছি নিজেকে অথবা পরিচিত কোনো মুখকে।

মাত্র ২১৫ পৃষ্ঠার বইতে যেমন মোহনীয় জগৎ আর কাহিনীর গভীরতা সৃষ্টি করেছেন সত্যিই প্রশংসনীয়। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছিলো অসংখ্যা মেটাফোর, যাট অর্ধেকও আসলে বুঝিনি। বাকি অর্ধেক নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছি। এই বইয়ের টার্গেট অডিয়েন্স আসলে কারা সে সম্পর্কে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা, পরিচিত যারা পড়েছেন তাদের মাথায়ও ঘুরে বেড়াচ্ছে এই একই কথা। বইয়ের পিছনের দর্শণটা আসলেও হয়তো বুঝি নাই তবুও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপভোগ করছি বইটা, এর ঘোর কাটতেও বেশ সময় লাগবে।

ফ্যান্টাসী বই হওয়া স্বত্বেও এখানে মুহূর্তে মুহুর্তে ম্যাজিক ছিলো না। বইয়ের আসল জাদু ছিলো লেখনীতে। বছর কয়েক আগে মাঝরাতে লেখকের অক্টারিন এক চ্যাপ্টার পড়ে ভীষণ ভয় পেয়ে রেখে দেওয়ায় পরবর্তীতে লেখকের অন্য কোনো বই পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে বিরূপকথার লেখনী অসম্ভব সুন্দট মনে হয়েছে আমার। বই দাগানো ভীষণ অপছন্দের একটা কাজ, তবুও এই বই দাগিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছি। কারণ লাইনে লাইনে অদ্ভুত মায়াবী কিছু উক্তি আছে, যা বারবার পড়তে মন চায়৷ কিছু উক্তি হৃদয় ছুয়ে যায়, কিছু আবার তীক্ষ্ণ তীরের ফলার মতো হৃদয়ে গিয়ে বিঁধে। কিছু প্রিয় উক্তি জুড়ে দিলাম।

* হয়ত আজকে প্রথমবারের মতো মল্লার বুঝতে পারলো রাগ আর অভিমানের মধ্যে একটা বিচিত্র জায়গায় পার্থক্য আছে। রাগ হলে মনে হয় মনের ভিতর যা আছে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে, সামনে যে আছে তাকে উড়িয়ে দিতে চাইছে। অভিমান সে তুলনায় চাপা, লাজুক, নীরব। অভিমানের সময় মনে হয় পুরো মহাবিশ্ব ষড়যন্ত্রে নেমেছে আজ আমার বিরুদ্ধে। ছোট ছোট ভুল হলে, বিরক্তিকর ঘটনা ঘটলে মনে হয় হ্যাঁ, হবেই তো, আমার সাথে না হলে আর কার সাথে হবে?

* এতোদিন মনে হতো ভবিষ্যৎ একটা গন্তব্য। পর্বতশৃঙ্গ। চূড়া পর্যন্ত পৌঁছানোটা কষ্টের, তবে পৌঁছাতেই হবে। মাঝে মাঝে না চাইতেও পথটা চূড়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়, পাদু’টোকে গেঁথে রাখে পাহাড়ের রুক্ষ মাটির বুকে। কিন্তু চূড়ায় পৌঁছানো হবে একসময়, তারপর শান্তি।
আজকাল মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ একজন শিকারি। ধেয়ে আসছে মল্লারের দিকে। তার গতিতে কোনো অস্থিরতা নেই। কোনো তাড়া নেই। মাথা ঠান্ডা, দৃষ্টি ভাবলেশহীন। মায়া নেই, নিষ্ঠুরতা নেই। শুধু আছে একটা জিনিস: নিশ্চয়তা। শিকার চেষ্টা করবে লুকাতে। চেষ্টা করবে পালাতে। ভান করবে শিকারির চোখ তার ওপর পড়েনি। তাতে শিকারির কিছুই আসে যায় না। সে জানে ঠিকই এসে পৌঁছাবে, জানে শিকারের পালাবার কোনো জায়গা নেই।

* "মনে হয় জীবন আমার জন্য না। কারণ আমি জানি কোনোকিছুই টেকে না। খারাপ, ভালো - কেনোকিছুই। এই যে কষ্ট করে সব বদলাচ্ছি, এসব আবার নিজে থেকে বদলে যাবে। যা পেয়েছি মুছে যাবে, সম্পর্ক জটিল হবে। শুধু কিছুদিনের মধ্যে যে ভালো জিনিসগুলো হয়েছে সেগুলো মনে থাকবে, আর বছর-বছর আগে যে খারাপ জিনিসগুলো হয়েছে সেগুলো মনে থাকবে।
আমার মনে হয় আমার মধ্যে একধরনের খালি জায়গা তৈরি হয়েছে। একটা শূন্যতা। যে সময়টায় অলস ছিলাম, তখন তৈরি হয়েছিলো। একসাথে থাকতে থাকতে এই শূন্যতা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সময়ের সাথে আমি বদলে গেছি, আমার সবকিছু বদলে গেছে- শুধু শূন্যতা বাদে। এখন আমার ভয় হয়। যদি শূন্যতা না থাকে, তাহলে কি আমি থাকবো?"