A review by __offsetpaper__
ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ by Krishan Chander

dark fast-paced

5.0

কৃষণ চন্দরের বই মানেই ব্যঙ্গাত্মক লেখার মাধ্যমে সমাজের নানান অসঙ্গতি চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেখিয়ে দেওয়া৷ তাঁর বইগুলোর কলেবর ছোট হওয়ার কারণে এক বসায় পড়ে শেষ করা যায়। কিন্তু এই অল্প কলেবরের মধ্যেই সমাজে বিদ্যমান প্রত্যেকটা বৈষম্যকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেন তিনি। 

তেমনই একটা বই হলো 'ভগবানের সাথে কিছুক্ষণ'। এই বইটা একদিকে যেমন সুখপাঠ্য তেমনি অপরদিকে পাঠকের চিন্তাভাবনার দিকে কয়েকটা প্রশ্নও ছুড়ে দেয়। 
.
.
বইয়ের কাহিনী নিয়ে যদি বলি, ভগবান স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে এসেছেন মুম্বাই ঘুরে দেখার জন্য। উদ্দেশ্য মুম্বাই শহরের নিষ্পাপ শিশুদের সাথে পরিচিত হওয়া। যেহেতু শিশুদের সাথে পরিচিত হতে বেশি কিছুর দরকার পরে না, তাই তিনি সাথে করে তেমন একটা টাকা-পয়সাও আনেননি, আবার নিজের যা শক্তি ছিল, সব স্বর্গলোকেই ফেলে এসেছেন। মর্ত্যে এসেই ভগবানের সাথে আমাদের কথকের দেখা। ভগবান এমন বিনা নোটিশে মর্ত্যে চলে আসায় কথক যারপরনাই বিরক্ত। এমনিই মুম্বাই শহরে পা ফেলা যায় না, তার উপর আবার কোত্থেকে এই উটকো ঝামেলা চলে আসলো! কিন্তু ভগবানের অনুরোধ কি আর ফেলে দেওয়া যায়? তো আর কী করার, ভগবান আর তার মানব বন্ধু, দুইজন মিলে দুই শিশুর রূপ নিয়ে মুম্বাই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। 

দুনিয়ার কূটকাচালির সাথে অনভ্যস্ত ভগবান এখানে এসে বেশ বিপাকেই পড়লেন৷ যাকেই ভালো মনে করছেন, কিছুক্ষণ পর সেই তাঁকে ঠকিয়ে যাচ্ছে, লাঞ্চিত করে যাচ্ছে। কোথায় নিষ্পাপ কিছু শিশু দেখার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু এসে দেখলেন এখানকার শিশুরা চাঁদাবাজি করে, মদ সাপ্লাই দেয়, আবার কাউকে খুন করতেও পিছপা হয় না৷ 

এইজন্যই বোধহয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।"
.
.
মুম্বাই শহর ঘুরে ঘুরে ভগবান সমাজের যেই দৈন্যদশা ও বিভিন্ন অসংগতি দেখলেন, তা শুধু তৎকালীনই নয় বরং এখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটেও এই গল্প দারুণ প্রতীকী। যুগের পরিবর্তন হলেও সমাজের কোন পরিবর্তন হয়নি। সমাজ একই জায়গাতে রয়েছে। নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির এমন শোচনীয় অবস্থা দেখে ভগবান নিজেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যান।

গল্পটায় ডার্ক কমেডি প্রকট, একটু পর পর কথকের মাধ্যমে কৃষণ চন্দর ভগবানের দিকে নিজের তীর্যক মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিলেন। বইটাতে শ্লেষ আর বিদ্রুপের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে দুনিয়ার এমনই বেহাল দশা যে ভগবানকেও মানুষের লাথি খেতে হয়। এখানে টিকতে হলে ভগবানের করুণা নয়, প্রয়োজন অর্থকড়ি আর চাটুকারিতা। ভগবানের নাকানিচুবানি খাওয়ার ঘটনাগুলো আপনাকে একই সঙ্গে হাসাবে আর ভাবনার গভীরেও নিয়ে যাবে। 

বইয়ের একটা প্যারা একদম মনে দাগ কাটার মতো, "এই জগতের কেউ ভগবানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে না। তাতে কিছু না কিছু স্বার্থ থাকেই। যার যে বস্তুর অভাব, সেটুকু পাবার জন্যে তোমার কাছে ধর্ণা দেয়। আর যার সবকিছুই আছে সে নিজের জন্য এই জগতেই স্বর্গ তৈরি করে আর পরকালে নিজের জায়গা নেয়ার জন্য ভগবানের কাছে আসে। লক্ষ লক্ষ টাকা কালোবাজারি করে একটা মসজিদ বা মন্দির বানিয়ে ভগবানকে খুশী করা ঘুষ নয় তো কি? এরা ভগবানের পূজা করে না, নিজেদের ইপ্সিত বস্তুর পূজা করে। নিজেদের ভয়ের পূজা করে।" 

দুঃখজনক হলেও, এইটাই সত্যি৷ সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা কেবল প্রয়োজনের সময়ই ধর্ণা দিই৷ স্বার্থ উদ্ধার হলেই আমরা আবার কেটে পড়ি। 

কিন্তু ভগবান যেই উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছিলেন, একটা শ্বেত শুভ্র পবিত্র শিশুর খোঁজে, তা কি শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলেন?

রেটিং: ৫/৫