A review by meowreads_94
গোরা by Rabindranath Tagore

5.0

গোরাকে নিয়ে লিখতে গেলে সাহসের দরকার। আমার মতো অর্বাচীনের লেখা উচিত না তারপরও নিজেকে থামাতে পারলাম কোথায়! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বমানের উপন্যাসটি এতো দেরিতে পড়ে শেষ করবার জন্য বরং একটু লজ্জা নিয়েই মনের কথাগুলো লিখছি নিচে।

গোরার গোঁড়ামি আছে বলাতেই সেদিন শিশিরের সাথে তুমুল হয়ে গেল একচোট। তার আবার খুব প্রিয় বই কিনা এটা। এক কোথায় শুনিয়ে দিল,' তুমি আসলে গোরাকে বুঝতেই পারোনি।" তা আমি বললাম, "রোসো বাপু! পড়ে শেষ করে নিয়ে বলছি"। আমি এখনো বলছি গোরা বা গৌরমোহন বাবুর গোঁড়ামি ছিল। তবে তা একটু অন্যরকম আর কি। গোরা ভারতবর্ষকে নিজের সবকিছুর থেকে বেশি ভালবাসতে চেয়েছিল, তাই তার সংস্কার-কুসংস্কার, আচার, নিয়ম, ধর্ম সবকিছুকে প্রাধান্য দিয়েছে নিজের আবেগের থেকে বেশি। বা বলা চলে নিজের মনকে তৈরি করে নিয়েছে এদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তাই গোরাকে প্রথম প্রথম খুব অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে চলা গোঁড়ামিপূর্ণ এক যুবক মনে হলেও খুব ধীরে ধীরে তার চরিত্রের বিশাল দিকটা সামনে আসে। গোরা নিজেকে ভাবে ভারতবর্ষের সন্তান। সে সমস্ত ছোট ছোট জিনিসকেও যোগ করে ভারতবর্ষের সম্মানরক্ষার সাথে। প্রথম নজরে গোরাকে কূপমণ্ডূক মনে হবে, অনেক কিছু , তার অনেক কথা-আচরণ দেখে সে কি আসলে প্রগতিশীল না পিছুখেয়ালের লোক তা বুঝতে গিয়ে বিভ্রান্ত হতে হবে কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ আসল রূপ খুব ধীরে ধীরে একটা বলয় তৈরি করে যেটা থেকে চোখ ফেরানো দায়।

গোরার আদর্শ বা নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার যে চেষ্টা এবং বলিদান , একইসাথে তার আত্মবিশ্বাস মুগ্ধ করে কিন্তু তা দিয়ে আমি তার মানবিকতার মূল্য দেবার চাইতে জাতিভেদ বা হিন্দুসমাজের আচার নীতি রক্ষার মধ্যদিয়ে দেশপ্রেমের প্রমাণ করাকে গোঁড়ামি না বলতে পারিনা। এজন্য ক্ষমা চাচ্ছি। তবে হ্যাঁ! গোরাকে গভীরভাবে বুঝতে গেলে শিহরিত হতে হয় বৈকি। কিছু জিনিসকে রক্ষার মধ্য দিয়ে ইংরেজি বা নব্য প্রথার শিকড়ে আঘাত হানবার পদ্ধতি তার অভিনব সেই সাথে নিজের বিশ্বাসে অটল থাকবার শক্তিটুকুও। তাই একদম শেষে গোরাকে ভেঙ্গে পরতে দেখে প্রচণ্ড খারাপ লাগে।

গোরা উপন্যাসটি রবি বাবুর সবচেয়ে শক্তিশালী উপন্যাসের একটা এটা চোখ বুজে মানতেই হবে। এর প্রতিটি চরিত্র নিজ নিজ আলোয় উজ্জ্বল। একটু ভেবে দেখলে অবাক হতে হয় এই যে গোরা আর বিনয় জেন এক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। একজন আবেগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আদর্শকে অন্যভাবে গড়ে নিচ্ছে, আরেকজন পরিবার-বন্ধুত্ব-প্রেমের থেকে নিজের ভাবাদর্শকে মাথা উঁচু করে দাড় করিয়ে রাখছে। বিনয় না থাকলে গোরার নীরব টানাপড়েন বা ত্যাগ গুলো সেভাবে কখনই বোঝা যেত না হয়তো। তেমনিভাবে ললিতা আর সুচরিতার চিন্তা ভাবনাতেও কি বিশাল পার্থক্য কিন্তু তারপরও কোথাও যেন অনন্ত মিল দেখা যায়। আবার আনন্দময়ী আর পরেশবাবু যেন একই ছাঁচে গড়া। "ধর্মের চেয়ে মানবিকতা সত্য- বড় বেশি সত্য " এ কথাটি তাদের দুজনের মধ্য দিয়েই যেন বারবার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সবশেষে একটা উপযুক্ত সমাপ্তি মনে হয় যেন উপন্যাসটাকে সম্পূর্ণ করেছে। গোরার রদবদল ও আসল পরিচয় উন্মুক্তের মধ্যে দিয়েই মনে হয় যেন এক সত্যের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন লেখক মাত্র দুটি পৃষ্ঠার মাধ্যমে যার প্রস্তুতি চলেছে এক বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে। গোরা এমন একটি উপন্যাস একমাত্র একে অবলম্বন করেই বিশ্বসাহিত্যের সেরাদের কাতারে ঠাকুর সাহেবকে দাড় করিয়ে দেওয়া যায়। তবে গোরাকে মূল্যায়নের জন্য অবশ্যই পরিপক্বতার দরকার। আমার মনে হয় এই উপন্যাস দিয়ে একজন পাঠক মনেরও পরিমাপ করে নেওয়া যায় যে সে আসলে কতটুকু মনের দিক দিয়ে সাবালক হয়েছে।